জীবন যুদ্ধে হার না মানা নারী
প্রতিক্ষণ ডটকম:
বয়স এখনও ত্রিশ ছোয়নি তার। কিন্তু, ভাগ্যের র্নিমমতায় নামের আগে বিধবা শব্দটি যোগ হয়েছে। তার শরীরের অবস্থাও ভাল নয়। বলা চলে শারীরিক প্রতিবন্ধী। দু’হাতে তেমন বল (শক্তি) পান না তিনি। তবুও ব্যস্ততম শহরের বুক চিরে প্রতিদিন পরিবারের সব সদস্যের মুখে দু’মুঠো ডাল ভাত তুলে দিতে নিরন্তর শ্রম দিচ্ছে এই সাহসী কর্মজীবী নারী। নাম বিথী বেগম। যশোর শহরের রাস্তায় ছুটে চলা যাত্রীবাহি (ব্যাটারিচালিত) ইজিবাইক চালক।
যশোর শহরতলী বিরামপুরের গাবতলায় পরের জায়গায় ঘর তুলে দু’ছেলে, অসুস্থ মা আর নানিকে নিয়ে থাকেন বিথী। সংসারের খরচ চালাতে বছরখানেক আগে ইজিবাইক চালানো শুরু করেন। এর আগে তিনি এলাকায় শাড়ি-কাপড় ফেরি করে বিক্রি করতেন।
সাতক্ষীরার কলারোয়ায় বিথীর শ্বশুরবাড়ি। স্বামী-সংসার নিয়ে একসময় ডাল-ভাত খেয়ে মোটামুটি সুখেই ছিলেন তিনি। বছর ৯ আগে স্বামী জুলফিকার আলী গাছ থেকে পড়ে আহত হন। তার মেরুদন্ডের হাড় ভেঙ্গে যায়। রাজধানীতে নিয়ে স্বামীর চিকিৎসায় ব্যয় হয়ে যায় অনেক টাকা। বিক্রি করতে বাধ্য হন স্বামীপক্ষ থেকে পাওয়া সব জমি-জিরাত। সব বিক্রি করেও শেষরক্ষা হয়নি তার। স্বামী জুলফিকার আর সুস্থ হননি। মারা যান, তাও প্রায় ৮ বছর হলো। ছোট ছেলে তানজিল তখন পেটে।
বিথীর সাথে কথা বলে জানা যায়, ‘স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই যশোরে মা ও নানির সাথে আছেন। বড় ছেলে তানভীর ইসলাম যশোর উপশহরস্থ একটি মাদ্রাসায় চতুর্থ শ্রেণিতে আর ছোটছেলে তানজিল ইসলাম দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। সেখানে আরবির পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজিও পড়ানো হয়।’ নিজে খুব বেশি লেখাপড়া না শিখলেও সন্তান দুটিকে সর্বোচ্চ ক্লাস পর্যন্ত লেখাপড়া করানোর প্রবল ইচ্ছা বিথীর।
যশোর শহর ও শহরতলীর প্রায় সব জায়গায় তিনি যাত্রী বহন করেন। দড়াটানা মোড় থেকে পালবাড়ি ভাস্কর্যের মোড়, কিংবা খাজুরা বাসস্ট্যান্ড থেকে মণিহার অথবা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল সবখানেই তিনি যাত্রী নিয়ে যান। তার কোমল হাতে শক্ত করে ধরে সাচ্ছন্দ গতিতে বাইক চালিয়ে পৌঁছে দেন যাত্রীদের কাঙ্খিত গন্তব্যে।
এখন পর্যন্ত যশোরের একমাত্র নারী চালক হিসাবে বেশ মর্যাদা নিয়েই তিনি প্রতিদিন সম্পাদন করছেন নিজের কাজ উপার্জন করছেন পরিবারের জন্য। পিছু ফিরে তাকানোর মত সময় নেই তার!
চালক হিসাবে তাকে যাত্রীদের ভীষণ পছন্দ। এমনই এক যাত্রী নিপু জানান, ‘পুরুষ চালকরা বেশ বেপরোয়া গতিতে বাইক চালায়। কিন্তু, উনি (বিথী বেগম) তাদের মত নন, সাবলীলগতিতে চালান। শহরে নিয়মিত আসতে হয়। সেকারণে ইজিবাইক ব্যবহারও করতে হয় নিয়মিত। উনি থাকলে তার বাইকেই উঠি।’
সংসারের ব্যয়নির্বাহে প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ইজিবাইকে শহরময় যাত্রী পরিবহনে কাজ করতে হয় বিথী বেগমের।
তিনি বলেন,‘বাইকের হ্যান্ডেল ধরতে কষ্ট হয়। হাত দুটোয় তেমন বল পাই না। তবুও ছেলে আর মা-নানির কথা চিন্তা করে চালিয়ে যাচ্ছি। আর মেয়েমানুষ বলে আসরের আজানের পর আর গাড়ি চালাই না।’
প্রতিদিন গড়ে দেড়শ’ থেকে দু’শ’ করে টাকা উপার্জন হয় বিথী বেগমের। এই টাকায় কোনোমতে চলছে তার সংসার।
বিথী বলেন, ‘পরের জায়গায় ঘর তুলে থাকি। সেখানে জায়গার ভাড়া মাসে আড়াইশ’ টাকা দিতে হয়। ছেলে দুজনের লেখাপড়ার খরচ, সংসারের খরচ- বেশ কষ্টেই চলে দিন।’
নিজের একটা বাইক থাকলে অনেক সাশ্রয় হতো বললেন বিথী। কেননা প্রতিদিন ইজিবাইকের মালিককে দিতে হয় সাড়ে চারশ’ টাকা।
জীবনযুদ্ধে লড়াকু এই মানুষটার একটাই স্বপ্ন সন্তান দুটি যেনো লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হয়।